মা। বলেই খানিক থামলেন। চেষ্টা করলেন নিজেকে সামলাতে। কিন্তু শৈশবের স্মৃতি উথলে উঠতেই গলা বুজে এল। বারবার কথা থামিয়ে আবেগ সামাল দিতে হল নরেন্দ্র মোদীকে।
লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পাওয়ার পরে লালকৃষ্ণ আডবাণীর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসেছিল মোদীর। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সেই ছবি। আর রবিবার ফেসবুক দফতরে মার্ক জুকেরবার্গের পাশে বসে জনতার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মায়ের কথা উঠতেই ফের আবেগবিহ্বল প্রধানমন্ত্রী।
কান্নাভেজা গলায় বললেন, এক সময় বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে, কাপড় কেচে, জল তুলে কোনও মতে সংসার চালাতেন তাঁর মা। এখন নব্বইয়ের কোঠায় বয়স। আজও নিজের সব কাজ নিজেই করেন। ‘‘সুতরাং বুঝতেই পারছেন, নিজের সন্তানদের জন্য এক জন মা কী কী করতে পারেন!’’ উচ্চকিত হাততালি বোঝাল সিলিকন ভ্যালি আজ মোদীতে মোহিত।
একটু আগেই সংস্কারের গতি কেন বাড়ছে না, সেই প্রশ্ন অবশ্য ধেয়ে এসেছিল। ভারতে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সত্যিই আগের চেয়ে সহজ হয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল। মোদী তার উত্তরে বলেছিলেন, একটা স্কুটারকে আধ সেকেন্ডে ঘোরানো যায়। চল্লিশ কামরার ট্রেন অর্থাৎ ভারতের মতো বড় দেশকে ঘোরানো সময়সাপেক্ষ। জনধন যোজনার মতো প্রকল্প সেই দুরূহ কাজটাই করছে বলে দাবি করেন তিনি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন, ভারতের শক্তি হল তার থ্রিডি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, ডেমোক্রেসি আর ডিমান্ড। মানবসম্পদ, গণতন্ত্র আর চাহিদা। মোদীর কথায়, তার সঙ্গে আর একটা ‘ডি’ তিনি যোগ করেছেন। ডিরেগুলেশন, বিনিয়ন্ত্রণ। অতএব তাঁর আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা, সস্তা শ্রম, দক্ষ কর্মী আর বিরাট বাজারের সমাহারে ভারতই বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় ঠিকানা। প্রশ্ন উঠেছিল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে। ‘বেটি বচাও’ প্রকল্পের উল্লেখ করে মোদী সেখানে টেনে আনলেন দুর্গা-কালীর উদাহরণ। বললেন, একমাত্র ভারতই নারীশক্তিকে পুজো করে। গোটা অনুষ্ঠান জুড়েই অতএব নাটকীয়তার উপাদান থাকল ভরপুর। মায়ের জন্য কান্না তারই ক্লাইম্যাক্স।
আবেগঘন এই মুহূর্ত হঠাৎ তৈরি হয়নি। মোদী আর তাঁর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ নিয়ে আজ সারাদিন ধরেই উদ্দীপনায় ভাসছিল মার্কিন মুলুক। তখনও বৈঠকের বেশ কিছুটা দেরি। ফেসবুকে হঠাৎ বদলে গেল মার্ক জুকেরবার্গের প্রোফাইল ছবি। গেরুয়া -সবুজ রং। আর মাঝখানে সাদা-কালো জুকেরবার্গের হাসি মুখ। তার উপরে লেখা, ‘‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সমর্থনে আমার প্রোফাইল ছবিটা পাল্টে দিলাম।’’ তার পরই একই কায়দায় ছবি বদলালেন মোদীও।
গত বছরই ভারতে মোদীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জুকেরবার্গের। নিজের ফেসবুক পোস্টে সেই কথা লিখে কিছু দিন আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারতে গত বছর মোদীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। এ বার এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে সম্মানিত বোধ করছি।’’ মোদীও জুকেরবার্গের মন্তব্যে ধন্যবাদ জানিয়ে তখন বলেছিলেন, ‘‘আলোচনায় আগ্রহী আমিও। অনেক কিছু নিয়ে কথা হবে। আশা করি স্মরণীয় একটা অনুষ্ঠান হবে।’’ সেই ‘স্মরণীয়’ অনুষ্ঠানের জন্যই সবাইকে প্রশ্ন পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিলেন জুকেরবার্গ। খোলা আকাশের নীচে সেই প্রশ্নোত্তর পর্বই অনুষ্ঠিত হল ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে। গোটা অনুষ্ঠানটা সরাসরি সম্প্রচার করা হল ফেসবুকে। সেই ভিডিও-বক্সে তার আগে থেকেই বাজানো হচ্ছিল বলিউডি গান। জুকেরবার্গের পেজ এ দিন যেন হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারত।
গত কালই জুকেরবার্গ বলেছিলেন, তিনি চান ২০২০-র মধ্যে ইন্টারনেট যেন পৌঁছে যায় সকলের কাছে। মোদীরও লক্ষ্য, ভারতের ৬ লক্ষ গ্রামকে ইন্টারনেটের এক সুতোয় বাঁধা। এ দিন তিনি বলেন, আগে নদীর ধারে সভ্যতার জন্ম হতো। তাঁর বিশ্বাস, আগামী দিনে অপটিক্যাল ফাইবারের নেটওয়ার্ক যেখানে, সেখানেই জন্ম নেবে নতুন সভ্যতা। একুশ শতকে ‘হাইওয়ে’র পাশাপাশি ‘আইওয়ে’-ও সমান জরুরি।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি মোদীর এই আগ্রহ তো নতুন নয়। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে ডিজিটাল মঞ্চ বিপুল ভাবে ব্যবহার করেছিলেন মোদী। নিজে ফেসবুক-টুইটারে নিয়মিত লেখেন। মাইগভ.ইন-এর পরে এ বার ‘নরেন্দ্র মোদী’ অ্যাপ চালু করছেন। জনসংযোগের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার যে জুড়ি নেই, এ কথা আজ বারবার স্বীকার করলেন তিনি। বললেন, বেশি পড়াশোনার সুযোগ পাননি ছোটবেলায়। ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বের জানলা তাঁর জন্য খুলে গিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এগুলো কতটা উপযোগী, বোঝাতে গিয়ে মোদী বলেন, ‘‘আগে ভুল শুধরোনোর সুযোগ আসত পাঁচ বছরে এক বার। এখন প্রতি পাঁচ মিনিটে সেই সুযোগ মেলে সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে।’’
ফেসবুক এসে দেওয়ালের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে অন্তর্জালে। ফেসবুক সদর দফতরের সাদা দেওয়ালও মোদীর হস্তাক্ষর রেখে দিল এ দিন। ‘অহিংসা পরম ধর্ম। সত্যমেব জয়তে। বন্দে মাতরম।’ নীচে সই, নরেন্দ্র মোদী।