ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া— নামটাই যথেষ্ট ছিল বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কট্টরপন্থী মুসলমান যুব সমাজকে মধ্য এশিয়ার ধূ ধূ মরু প্রান্তরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাঙে জোয়ার ছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির। মাত্র এক বছর আগেও আইএসআইএস রোজ ফুলে ফেঁপে উঠত। ২০১৫তে পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই বিপরীত।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অন র‌্যাডিক্যালাইজেশন (আইসিএসআর)-এর রিপোর্ট বলছে, মরু-জেহাদে এখন ভাঁটার টান। যোগদান নয়, আইএসআইএস-এ এখন দলছুট হওয়ার হুজুগ।
তথাকথিত জেহাদিরা বিপুল সংখ্যায় আইএসআইএস ছেড়ে পালাতে সফল, এখনও তেমনটা বলার সময় আসেনি। কিন্তু, মাত্র কয়েক মাসের চেষ্টাতেই সমীক্ষকরা ৫৮ জনকে পেয়েছেন, যাঁরা আইএস ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁরাই বলছেন, পালানোর সুযোগের অপেক্ষায় এখন হাজারে হাজারে।
আইএস-ছুটরাই এখন আইএস-এর সবচেয়ে বড় শত্রু। পালানোর কারণটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। কিন্তু, ‘কমন ফ্যাক্টর’ও একটা রয়েছে। আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে হলেও প্রায় প্রত্যেক আইএস-ছুটই বলছেন, এই সংগঠন ইসলামকেই ধ্বংস করছে।
দলছুটদের মধ্যে অধিকাংশেরই মত, আইএস মুসলমানদের প্রাণই বেশি করে নিচ্ছে। সিরিয়ায় আসাদ জমানার অবসান ঘটাতে তারা তুমুল যুদ্ধ করেছে। কিন্তু, সে যুদ্ধ নাকি আদর্শ ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নয়। আসাদ প্রশাসনের হাতে লাঞ্ছিত ছিল যে সুন্নিরা, তাঁদের রক্ষা করতে আইএস কিছুই করেনি। অন্দরের খবর, সুন্নি বিদ্রোহীদের অন্য গোষ্ঠীগুলিকে খতম করে গায়ের জোরে নিজেদেরকে সুন্নি সম্প্রদায়ের এক মাত্র প্রতিভূ হিসেবে তুলে ধরাই আইএস-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাই আইএস-এর হাতে রোজ প্রাণ গিয়েছে সুন্নি মুসলমানের। আর আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রাণ গিয়েছে শিয়াদের। তাঁরাও মুসলমান।

দলছুটদের আর একটি ভাগ বলছে, আইএস অত্যন্ত নিষ্ঠুর। সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার রোজকার ঘটনা। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে সাধারণ গ্রামবাসী এমনকী নারী বা শিশুকে কালশনিকভে ঝাঁঝরা করতেও কারও হাত কাঁপে না এই সংগঠনে।
আর এক দল বলছেন, আইএস প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত। কম্যান্ডাররা সুবিধাভোগী এবং স্বেচ্ছাচারী। তাঁরা নাকি ইসলামের আদর্শ মেনে চলেন না। নিজেদের সুবিধা মতো আইন করেন। সিরীয় দলছুটরাই এই অভিযোগ বেশি করে তুলছেন। এক ভারতীয় আইএস-ছুট সমীক্ষক সংস্থাকে জানিয়েছেন, গায়ের রং চাপা হওয়ায়, তাঁকে দিয়ে শৌচাগার সাফ করানো হত। ওই ভারতীয়ের কথায়, কোনও ধর্মযুদ্ধে এমন বর্ণবৈষম্য থাকতে পারে না।
আরও একটি শ্রেণি রয়েছে, যাঁরা স্বপ্নভঙ্গের কারণে আইএস ছেড়েছেন। জেহাদি শিবিরে পৌঁছে বিলাসী জীবন মিলবে, আশ্বাস মিলেছিল যোগদানের আগে। কিন্তু, প্রতিশ্রুতি মতো গাড়ি-বাড়ির বিলাস, উৎসব মত্ত জীবন মেলেনি। তাই ছেড়ে দিয়েছেন আইএস।
শেষোক্ত শ্রেণির বয়ান অপিরসীম স্বার্থান্বেষীর মতোই শোনায়। বিলাসী জীবনের মোহে নিষ্ঠুরতার সাধনায় মেতে উঠতে দ্বিধা হয়নি এঁদের। বিলাস না মেলায় জঙ্গি শিবির ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে, বাকিদের প্রত্যেকের কথায় স্পষ্ট, আইএস ইসলামের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বললেও, কার্যক্ষেত্রে ইসলামকেই ধ্বংস করছে বলে তাঁরা মনে করেন।
সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ, আইএস-ছুটদের সকলেই যে সাধু-সন্ত গোছের, তা নয়। তাঁদের অনেকেই এত দিন ধরে বহু অপরাধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু, এই দলছুটদের কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য। তাঁদের মোহভঙ্গের কারণ সম্পর্কে যা তাঁরা বলেছেন, তা সত্যিই ভাবার মতো বিষয়।
রিপোর্ট আরও বলছে, মাত্র ৫৮ জনের দলছুট হওয়া দিয়ে মাপা যাবে না মরু-জেহাদে সঙ্কট এখন কতটা গভীর। কারণ, বিদ্রোহের বা দলছুট হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাকুল এখন হাজারে হাজারে। অপেক্ষা শুধু সুযোগের। সে কথা আঁচ করেই বজ্র আঁটুনি দিয়েছেন কম্যান্ডাররা। তাহলে কি ফস্কা গেরোর দিনও এগিয়ে আসছে?