এই সমীক্ষা যাঁদের মধ্যে করা হয়েছে তাঁরা মূলত গরিব এবং নিরক্ষর। এই অসহায় মহিলারাই শরিয়ত আইনের যত রকমের অপপ্রয়োগের শিকার। সব জায়গায় সমস্যা সমান নয় নিশ্চয়ই। যেমন, শিক্ষিত এবং সম্পন্ন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তালাক বা বহুবিবাহ নেই বললেই চলে, কিন্তু রাজ্যের অনেক জেলাতেই নিম্ন আয়ের ও নিম্ন সামাজিক অবস্থার মুসলমানদের ‌মধ্যে তালাকের চল বেশি। আবার, যে সমস্ত অঞ্চলে মহিলারা বিড়ি বেঁধে, জরির কাজ করে বা অন্য কোনও উপায়ে উপার্জন করে খানিকটা স্বাবলম্বী, সেখানে তালাকের প্রবণতা কম। কিন্তু মহিলা সংগঠনগুলোর বক্তব্য, এমন একটা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হবে কেন, যা দেশের আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে পুরুষকে একতরফা ভাবে তালাক দেওয়ার অধিকার দেবে? অথচ তালাক নিয়ে শরিয়তের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে বাংলাদেশে, এমনকী পাকিস্তানেও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ব্যাপক সংস্কার করে ১৯৬১ সালে তৈরি হয় মুসলিম পারিবারিক আইন। সে দেশে তালাক দেওয়ার কোনও সহজ চটজলদি ব্যবস্থা আর নেই। প্রথম স্ত্রীর লিখিত অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়েও করা যায় না। এখানে তালাকের বা বহুবিবাহের ওপর বিচারবিভাগ বা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মুসলিম মহিলারা, শিশুরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। এর ফলে গোটা মুসলমান সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছে বলে মনে করছে ওই সংগঠনগুলো।
এ দেশে শরিয়ত নিয়ন্ত্রিত মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার কি সম্ভব? মুসলিম পাসোর্নাল ল বোর্ড সে দাবি আগেই বাতিল করেছে। জামাআতে ইসলামি হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার আমির-এ হালকা (সভাপতি) মহম্মদ নুরুদ্দিন শরিয়তের ন্যূনতম সংস্কারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই সব নারী সংগঠনের আন্দোলন আসলে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের দাবিকেই জোরদার করছে।’ ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের রাজ্য শাখার আহ্বায়ক রহিমা খাতুনের বক্তব্য, ‘কোরানে যে বিধান রয়েছে তার ভিত্তিতেই আইন হোক, যে আইনে একসঙ্গে তিন বার তালাক বলে বউকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া যাবেও না, বউয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে যে আইন স্বামীকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে, ফয়সালা হবে আদালতেই।’ সেই রকম আইনের একটা খসড়া আন্দোলনের কর্মীরা ইতিমধ্যেই তৈরি করেছেন।
তবে মুর্শিদাবাদের ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’র নেত্রী খাদিজা বানু আরও অনেকটা এগিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যদি শরিয়ত আইনের সংস্কার সম্ভব হয় তা হলে ভারতের মতো একটা সেকুলার দেশে হবে না কেন?’ তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, ‘ব্যাঙ্ক, বিমা বা ফৌজদারির ক্ষেত্রে মুসলমান যদি শরিয়ত সরিয়ে রেখে দেশের আইনে চলতে পারে তা হলে তালাক, সম্পত্তির ‌উত্তরাধিকার বা দত্তকের জন্যও শরিয়ত আইনের প্রয়োজন হবে কেন!’ খাদিজা বানু ও তাঁর সংগঠন মুর্শিদাবাদ এবং পাশের কয়েকটি জেলায় তালাকপ্রাপ্ত গরিব মেয়েদের আইনি অবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকেন বহু দিন ধরেই।
শরিয়তে তালাকের যে প্রক্রিয়া ও প্রয়োগ‌ব্যবস্থা রয়েছে তা জটিল, সময়সাপেক্ষ। একটা তালাক কার্যকর হতে সংশ্লিষ্ট নারীকে তিনটি ঋতুকাল সময় (অন্তত তিন মাস) দিতে হবে। এক বারে তিন তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিদেয় করা অনুমোদিত নয়। তা হলে তালাক হবে কেমন করে? প্রথমেই জেনে রাখা দরকার, ইসলামে তালাক কোনও ভাবেই উৎসাহিত করা হয়নি। হজরত মুহম্মদের পরামর্শ ছিল, ‘তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা তালাক দিলে আল্লার আরস কেঁপে ওঠে।’ কোরানে (সুরা তালাক ৬৫:১) বলা হয়েছে, ‘হে নবি! তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে চাইলে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ রেখে ওদের তালাক দিয়ো। ইদ্দতের হিসাব রেখ।... তোমরা ওদেরকে বাসগৃহ থেকে বের করে দিও না। আর ওরাও যেন বের হয়ে না যায়, যদি না ওরা স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়।’
কোনও স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার পরের তিন মাস হল ‘ইদ্দত’। ওই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। তালাকপ্রাপ্ত মহিলা গর্ভবতী কি না তা নিশ্চিত করার জন্যই ইদ্দত। ইদ্দতকালে স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর। কিন্তু এ দেশে তার কোনওটাই হয় না। নিয়ম হল, প্রথম ও দ্বিতীয় বার তালাক বলার পরেও স্বামী চাইলে তৃতীয় বার তালাক বলা থেকে বিরত থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ রদ করতে পারেন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ হলে প্রথমে নিজেরা এবং পরে দু’জন মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিতে আলোচনা করে বিবাদ মিটিয়ে নিতে হবে। না মিটলে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে প্রথম বার তালাক উচ্চারণ করবেন, কিন্তু পরের তিন মাস (ইদ্দত কাল) একসঙ্গে বাস করবেন এবং বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন। ওই সময়ে বিবাদ মিটে গেলে তাঁরা আগের মতোই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকবেন। আর বিবাদ না মিটলে তালাক হয়ে গেল। কিন্তু তালাক হয়ে যাওয়ার পরে স্বামী-স্ত্রী ভুল বুঝতে পেরে যদি আবার একসঙ্গে থাকতে চান তাহলে বিরাট বিপদ। ওই স্ত্রীকে আবার অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে অন্তত চার মাস কাটানোর পরে সেই পুরুষ যদি নিয়ম মেনে তালাক দেন তবেই ওই মহিলা আবার তাঁর আগের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারবেন। এই পদ্ধতিকে বলে ‘হালালা’। এই প্রথা অনেক মুসলিমপ্রধান দেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ দেশে হালালা আছে বহাল তবিয়তে।
এখন তো পোস্টকার্ডে লিখে, ই-মেল করে এমনকী এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ করেও তালাক হয়ে যাচ্ছে। কোরানের স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও তিন তালাক হচ্ছে কেন? সুন্নি মুসলমানদের যে চারটি ‘মজহাব’ বা ‌খণ্ড সম্প্রদায় আছে তাদের তিনটি মজহাবে তিন তালাক গ্রাহ্য না হলেও ‘হানাফি’দের মধ্যে এই প্রথা আইনসিদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের শতকরা ষাট ভাগের বেশি মুসলমান ইরাকের সপ্তম শতকের ইমাম আবু হানিফা প্রবর্তিত হানাফি মতের। ইসলামি আইনশাস্ত্রে কোরান ও হাদিসের পাশাপাশি তেরোশো বছর আগের ওই আইনজ্ঞের অভিমতকেও কঠোর ভাবে মান্যতা দেওয়া হয়। এতটাই যে, অল ইন্ডিয়া পাসোর্নাল ল বোর্ড জানিয়ে দিয়েছে, এক বারে তিন তালাক বলে বিবাহবিচ্ছেদ অন্যায়, কিন্তু তা বন্ধ করা যাবে না। জামাআতে ইসলামির সভাপতি মহম্মদ নুরুদ্দিন পাসোর্নাল ল বোর্ডের মতটাকেই পরিষ্কার করলেন, ‘যদি কেউ আন্তরিক ভাবে, সজ্ঞানে, সচেতন ভাবে এক বৈঠকে তিন তালাক বলে তা হলে পদ্ধতিগত ভাবে ভুল হলেও তা তালাক হিসেবে গণ্য হবে।’
ইসলামি আইনের এত সব মারপাঁচ বোঝেন না গ্রামের দরিদ্র নিরক্ষর নারী। তিন তালাক বলার পরে সেই নারী যদি ছেলেমেয়ের হাত ধরে স্বামীর ভিটে ছেড়ে চলে না যান, তা হলে গ্রামের ইমাম-মুফতিদের আনিয়ে তাঁদের দিয়ে নিদান দেওয়ানো হয়। সচরাচর খারিজি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা এই সব ইমাম-মুফতিরাই বাংলার গ্রামে গ্রামে গরিব অশিক্ষিত মুসলমানের কাছে ইসলামের মুখ।
এ রাজ্যে তালাকপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা কত? কোনও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান হাতে নেই। মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল, হরিহরপাড়া, রাণীনগর, জলঙ্গী, সালার, ইসলামপুর, ভগবানগোলা বা বেলডাঙার মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে খাদিজা বানুর অভিজ্ঞতা, ‘এক একটি গ্রামে কমপক্ষে দশ জন, সর্বাধিক ষাট জন তালাক পাওয়া মহিলার সন্ধান পেয়েছি।’ রহিমা খাতুনের কাজ হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই জেলাগুলোতেই তালাক পাওয়া মহিলাদের নিয়ে তাঁদের সমীক্ষা। অবস্থাটা যে ‘খুবই খারাপ’ তা স্বীকার করে নিয়েও রহিমা কোনও সংখ্যা জানাতে রাজি হননি। তবে গত সপ্তাহে ফোনে কথা শুরু হতেই জানিয়েছিলেন, ‘এই তো কাল রাতেই খবর পেলাম স্বামী মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে বউকে তালাক দিয়েছে। পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেই বউকে বেরিয়ে যেতে হয়।’ এই রকমই চলতে থাকে। সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছে জেনেও শিক্ষিত মুসলমান পুরুষ কোনও অজ্ঞাত কারণে সমাজের এই ক্ষতটা আড়াল করতে ব্যস্ত। এই ক্ষত সারিয়ে তোলার দায় যেন কেবলই মেয়েদের।
কেউ চাইলে আইনের শরণাপন্ন হতে পারেন। কিন্তু আদালত তাঁদের বিচার করবে মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ডিভোর্স) অ্যাক্ট ১৯৮৬-এ। ওই আইনে বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলার স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার স্বীকৃত নয়। সেটা দেবেন মহিলার নিকট আত্মীয় বা ওয়াকফ বোর্ড। শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, সামর্থ্য আছে এমন মুসলমান পুরুষ তাঁর বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রীকে (যিনি নিজের ভরণপোষণে সমর্থ নন) খোরপোষ দেবেন, যত দিন পর্যন্ত ওই মহিলা আবার বিয়ে না করছেন। মুসলিম নেতাদের চাপে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়কে বানচাল করতে সংসদে মুসলিম উইমেন অ্যাক্ট পাশ করে। তালাক পাওয়া মেয়েরা আইনি সহায়তার যে আশার আলোটুকু দেখেছিল, তা-ও ধর্মীয় নেতা আর রাজনীতিকরা নিভিয়ে দেন। মুসলিম নারীর ভাগ্য পুরোপুরি চলে যায় এক শ্রেণির মোল্লা-মৌলবি-মুফতিদের হাতে। তাঁদের বক্তব্য: শরিয়ত ঐশী, তা স্পর্শ করা যাবে না। তাঁদের যুক্তি: ইসলামি আইনশাস্ত্রে বিভিন্ন মত রয়েছে, কোনটিকে অনুসরণ করা হবে? শরিয়তি আইনের সংস্কার আসলে অভিন্ন দেওয়ানি চাপিয়ে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
এ সব ছেঁদো যুক্তি এমনকী পাকিস্তানও বাতিল করেছে। ‘আধুনিক, দায়বদ্ধ, কল্যাণব্রতী’ ভারতের রাষ্ট্র এটুকু সাহস দেখাতে পারবে না?