ঘণ্টা দুয়েকের বৃষ্টিতেই ডুবে গেল শিলিগুড়ি শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। বুধবার সন্ধ্যার ঘটনা। নিকাশি বেহাল হয়ে পড়ায় শহরের অন্তত ৩০টি ওয়ার্ডের বেশ কিছু রাস্তা জলের তলায় চলে যায়। অনেক ঘরদোরও জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের নির্বাচনী ক্ষেত্রে (৬ নম্বর ওয়ার্ড) কয়েকশো বাড়িতে জল ঢুকে যায়। হাকিমপাড়া, সুভাষপল্লি, শক্তিগড়, তিলক রোড, বিধান রোড-সহ সংযোজিত এলাকার জলমগ্ন হয়ে পড়ে। রাত নটা নাগাদ শক্তিগড় এলাকার বাসিন্দারা নৌকাঘাটের কাছে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। রাস্তায় দুধারে শয়ে শয়ে যানবাহন আটকে পড়ে। রাতে অবরোধ ওঠে। হিলকার্ট রোডে পঞ্চনই সেতুর সংযোগ রাস্তার একাংশ জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। তবে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় জমে যাওয়া জল না-নামায় শিলিগুড়ির মেয়রের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিরোধী দলনেতা নান্টু পাল। মেয়র অবশ্য ওই দাবিতে গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে জলমগ্ন হলে যদি মেয়রকে পদত্যাগ করতে হয়, তা হলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আগে ইস্তফা দিতে হবে। কারণ, কলকাতায় জল নামতে দুদিন গড়িয়ে গিয়েছিল। যা কি না বাম আমলে কখনও হয়নি।’’
মেয়র জানিয়েছেন, অল্প সময়ের মধ্যে তুমুল বৃষ্টি হওয়াতেই শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শুধু শিলিগুড়ি নয়, আশেপাশের শহরেও জল জমে গিয়েছে। এত ভারী বৃষ্টির কোনও পূর্বাভাস না থাকাতে সমস্যা হয়েছে বলে মেয়র যুক্তি দিয়েছেন। বিরোধী দলনেতার অভিযোগ, রাজ্য সরকারের বরাদ্দে নিকাশির জন্য যে আধুনিক যন্ত্র-সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল, তার কোনটাই পুরসভা ব্যবহার হয়নি। হাইড্রেনগুলির মুখও পরিষ্কার করা হয়নি বলে অভিযোগ।
অশোকবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘ভিত্তিহীন অভিযোগের কোনও উত্তর দিতে চাই না। পরিস্থিতি সামলাতে পুরসভার সব আধিকারিক-সহ মেয়র পরিষদের সদস্য, কাউন্সিলররা রাস্তা নেমে তদারকি করছেন।’’ অশোকবাবু জানিয়েছেন, মহানন্দা নদীর জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় শহরের জল নর্দমা দিয়ে বের হতে পারেনি, উল্টে নদীর বেড়ে যাওয়া জল শহরে ঢুকে গিয়েছে। দলের হয়ে ভোট প্রচারে অশোকবাবু এ দিন সল্টলেকে ছিলেন। আজ, বৃহস্পতিবার তিনি শহরে ফিরবেন। তা নিয়ে নান্টুবাবুদের কটাক্ষ, ‘‘মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে উনি যতদিন খুশি কলকাতায় থাকুন।’’
নিকাশি বেহাল হওয়ায় ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে শক্তিগড় এলাকার অনেক বাড়িতে জল ঢুকে যায়। ওই এলাকার বাসিন্দা কানাই পাল, স্বপ্না সাহা, গোবিন্দ মণ্ডলরা রাস্তা অবরোধ করে অভিযোগ তোলেন, ‘‘গত চার বছর ধরে বৃষ্টি হলেই এলাকায় জল জমছে। বাড়িতে জল ঢুকে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে পুরসভার তরফে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।’’ শহরের নিকাশি বেহাল হয়ে পড়ার সমালোচনা করেছেন পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর তথা ৩ নম্বর বরো চেয়ারম্যান সুজয় ঘটকও। তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টি অতিরিক্ত তো হয়েছেই। আমার এলাকায় কিছুক্ষণ জল ছিলই। তবে শহরের একাংশে বেহাল নিকাশি ব্যবস্থাতে সমস্যা বেড়েছে। প্রতি বছর বর্ষার আগে শহরের সমস্ত হাইড্রেন পরিষ্কার পুরসভা করে। এ বছর তা ঠিকঠাক হয়নি। আর সাফাই কর্মীর ঘাটতিও রয়েছে। পুর কর্তৃপক্ষকে বলেও সাফাইকর্মী ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না।’’
বৃষ্টিতে জলমগ্ন শিলিগুড়ি শহরের
বিধান রোডের নানা এলাকা।
জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছেন
ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। নিজস্ব চিত্র।
পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর পিন্টু ঘোষ জানান, বৃষ্টি আধ ঘণ্টা হতেই ভাসতে থাকে গোটা ওয়ার্ড। খালাপাড়া, ঘোষপাড়া, বিবেকানন্দনগর, বিদ্যাসাগরপল্লি, নেহেরু রোড, শীতলাপাড়া, বিবেকানন্দ রোডে যে জল জমেছিল, তা ভাবাই যায় না। সেবক রোডের কয়েকটি শপিংমলের নীচতলায় জল জমে যায়। বিধানমার্কেটে অনেক দোকানে জল ঢুকে জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাইড্রেনগুলি পরিষ্কার না হওয়াতেই সমস্যা বেড়েছে। তৃণমূলের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা প্রাক্তন মেয়র পারিষদ দুলাল দত্ত বলেন, ‘‘এলাকায় জলে বাড়িঘর ভেসেছে। বিশেষ করে ৩৭-৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সংযোগস্থলে জোড়াপানি নদীর দুই পাশের বাড়িতে জল ঢুকেছে। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।’’
পুরসভার মেয়রের ওয়ার্ডের পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায় বলে বাসিন্দারা জানান। অশোকবাবুর বিরুদ্ধে ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছিলেন তৃণমূলের শ্রমিক নেতা তথা স্থানীয় বাসিন্দা অরূপরতন ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় ঘুরে মানুষের দুর্ভোগ দেখা যাচ্ছে না। ডাঙ্গিপাড়া, দ্বারভাঙাটোলা, ফকিরটোলা এবং কুরেশিমহল্লায় খাটের উপর লোকজন বসে রয়েছে। মেয়রের ওয়ার্ডের যদি এই হাল হয়, তাহলে বাকি শহরের কী অবস্থা বোঝাই যাচ্ছে।’’
জলমগ্ন হয়ে পড়ে রাজারামমোহন রায় রোড, নজরুল সরণি সহ হাকিম পাড়া এলাকা। বেশ কিছু বাড়ির নীচতলাতেও জল ঢুকে যায়। রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রাস্তায় জলবদ্ধতার সমস্যা দেখেছেন এলাকার কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষ। প্রচুর বৃষ্টির কারণেই জলবদ্ধতার সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেও, নিকাশির ক্ষেত্রে আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর কথায়, ‘‘জল বের হওয়ার অনেক পথ বন্ধ হয়েছে, বা সঙ্কুচিত হয়েছে। নিকাশিতে আরও একটু জোর দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে জল জমলেও, নামতে বেশি সময় লাগবে না।’’